সংহিতা কথার অর্থ কী? সংহিতা কয়টি ও কি কি ? ঋগ্বেদের শাখা ও বিভাগ , সংবাদ সূক্ত, দার্শনিক সূক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ সুক্ত, সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোচনা। এছাড়া সামবেদের শাখা ও যজুর্বেদের শাখা ও বিভাগ এর সম্পূর্ণ আলোচনা ।
Table of Contents
সংহিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোচনা কর
সংহিতা কথার অর্থ কী? সংহিতা কয়টি ও কি কি ?
বেদের মন্ত্রভাগের নাম সংহিতা। ইহা চারভাগে বিভক্ত – ঋকবেদ সংহিতা , সামবেদ সংহিতা , যজুর্বেদ সংহিতা ও অথর্ববেদ সংহিতা । এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বেদ ‘ঋগ্বেদ ; এমনকি এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শনও বটে।
চারটি সংহিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানতে নিচে ক্লিক করুন –
এর অপর নাম অথর্বাঙ্গিরসবেদ বা ব্ৰহ্মবেদ বা ‘ক্ষাত্ৰবেদ’। এই বেদের মুখ্য পুরোহিত ব্রহ্মা। তিনি ‘ত্রিবেদবিৎ’ এবং যজ্ঞ পরিচালনার প্রধান ভূমিকা তারই।
চতুর্থ বেদের নাম অথর্ববেদ। এই বেদ “ত্রয়ী’র অন্তর্গত নয় আবার ‘ত্রয়ী এরই মধ্যে নিবিষ্ট। যজ্ঞানুষ্ঠানকালে চারজন ঋত্বিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই ঋত্বিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রত্যেক প্রধান ঋত্বিকের তিনজন করে সহকারী ঋত্বিকও থাকতেন এই সময়ে। ত্রয়ী মন্ত্ৰাত্মক।
কিন্তু স্বতঃই প্রশ্ন জাগে : মন্ত্র কী? এ বিষয়ে ভগবান্ জৈমিনি সংহিতাত্রয়ের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ সূত্রিত করেছেন। ‘ঋক্’-এর লক্ষণ :তেষামৃক যত্ৰার্থবশেন পাদব্যবস্থা’ —জৈমিনিসূত্র ২।১।৩২
অর্থাৎ মন্ত্রসমূহের মধ্যে যে সব মন্ত্র এক একটি পরিপূর্ণ অর্থের বোধক এবং ছন্দে বদ্ধ, তারাই ঋক্ নামে অভিহিত
যে মন্ত্রগুলি গেয় সেগুলিই সাম। এবং শেষে যজুঃশব্দঃ
ঋক্ এবং সাম ব্যতীত অবশিষ্ট মন্ত্র যজুঃ।
ঋকবেদ সংহিতা
বৈদিক যজ্ঞের পুরোহিত ঋত্বিক্ নামে পরিচিত ছিলেন। যজ্ঞের অনুষ্ঠানের সময় সাধারণতঃ চারজন প্রধান ঋত্বিক থাকতেন। একজন মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দেবতাকে আহ্বান করতেন। যিনি এই কার্য করতেন, তাকে বলা হত হোতা। হোতার পাঠ্য সঙ্কলিত মন্ত্রসমূহ ঋক সংহিতা নামে পরিচিতি লাভ করে।
“সংহিতা’ শব্দের অর্থ সংগ্রহ বা সঙ্কলন। ঋক সংহিতা হৌত্রবেদ নামেও প্রচলিত, যেহেতু কসংহিতায় হোতার পঠনীয় মন্ত্রসমূহই সংগৃহীত।
ঋগ্বেদের শাখা
দুটি শাখা -১) শাকল শাখা (১০১৭টি সূক্ত) এবং বাস্কল শাখা (১০২৮টি সুক্ত)।
ঋগ্বেদের বিভাগ
ঋক সংহিতার বহু মন্ত্র পরবর্তী বেদে লক্ষ্য করা যায়। ঋক সংহিতার মন্ত্রবিভাগ দুই প্রকার – বৈদিক অনুষ্ঠানোপযোগী ‘মণ্ডলবিভাগ এবং বেদাধ্যয়নোপযোগী ‘অষ্টকবিভাগ।
১) বৈদিক অনুষ্ঠানের উপযোগী মণ্ডল বিভাগ এবং ২) বেদাধ্যয়নের উপযোগী অষ্টক বিভাগ।
মণ্ডলবিভাগ
১০টি মণ্ডল, ৮৫টি অনুবাক, ১০১৭টি সূক্ত এবং ১০৪৭২টি ঋক আছে।
বাস্কল শাখার অষ্টম মণ্ডলে ১১টি সূক্তসংখ্যা যুক্ত হয়ে ১০২৮টি সূক্ত এবং ৮০টি ঋক যুক্ত হয়ে ১০৫৫২টি ঋক হয়।
ঋক সংহিতায় শাখাভেদে এবং মণ্ডল বা অষ্টকভেদে এর মন্ত্রবিভাগে বেশ কিছু মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। সমস্ত মতান্তরের ভিত্তিতে কিছু আনুমানিক মন্ত্রবিভাগ উল্লেখ করা হল -১০টি মণ্ডল, ৮৫টি অনুবাক, ১০১৭টি সুক্ত এবং ১০৪৭২টি ঋক এবং ৮টি অষ্টক, ৬৪টি অধ্যায়, ২০০৬টি বর্গ এবং ১০৪৭২টি ঋক আছে।
অষ্টক বিভাগ
৮টি অষ্টক, ৬৪টি অধ্যায়, ২০০৬টি বর্গ এবং ১০৪৭২টি ঋক আছে।
প্রকীর্ণ মন্ডল
মণ্ডল বিভাগ অনুযায়ী ঋক সংহিতায় দশটি মণ্ডল। এর মধ্যে প্রথম ও দশম মণ্ডলে বিভিন্ন ঋষি কিংবা বিভিন্ন বিষয়ের সমাবেশ থাকায় এদুটি মণ্ডলকে ‘প্রকীর্ণ মণ্ডল বলা হয়।
ঋগ্বেদের প্রথম ও দশম মণ্ডলকে প্রকীর্ণমণ্ডল বলে। কারণ, এই দুই মণ্ডলের ভিন্ন ভিন্ন সুক্তগুলি ভিন্ন ভিন্ন ঋষি কর্তৃক দৃষ্ট হওয়ায় এবং বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হওয়ায় এগুলিকে প্রকীর্ণ মণ্ডল বলে।
ভাষা ও বিষয়বস্তুর বিচারে পণ্ডিতগণ মনে করেন এই দুটি মণ্ডল অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা।
আর্ষমন্ডল / গোষ্ঠীমন্ডল/ পারিবারিকমন্ডল
ঋগ্বেদের দ্বিতীয় থেকে সপ্তম – এই এই ছয়টি মণ্ডলে গৃৎসমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ, ও বশিষ্ঠ – এই ছয়জন ঋষিকুলের শ্রুতিরক্ষিত মন্ত্ররাশি সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তাই এই মণ্ডলগুলিকে আর্যমণ্ডল/ গোষ্ঠীমণ্ডল/ পারিবারিক মণ্ডল বলা হয়। অনেকে অষ্টম মণ্ডলকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
দ্বিতীয় থেকে সপ্তম – এই ছয়টি মণ্ডলে ছয়জন ঋষিকুলের শ্রুতি রক্ষিত হয়েছে বলে একে গোষ্ঠী মণ্ডল বলে।
সোম মন্ডল / পবমান মন্ডল:-
ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল সোম মণ্ডল / পবমান মণ্ডল নামে পরিচিত। নবম মণ্ডলের ১১৪টি সূক্তেই পবমান সোম দেবতার স্তুতি করা হয়েছে।
অপরদিকে প্রগাথা গোষ্ঠী দ্বারা সংকলিত অষ্টম মণ্ডলকে প্রগাথ মণ্ডল এবং পবমান সোমের স্তুতিমূলক নবম মণ্ডলকে সোম মণ্ডল বলা হয়।
প্রগাথ মণ্ডল
ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের সুক্তগুলি মূলতঃ প্রগাথ নামক এক প্রকার মিশ্র ছন্দে রচিত ও কণ্ব- পুত্র প্রগাথা নামক গোষ্ঠী দ্বারা সংকলিত তাই এই মণ্ডলকে প্রগাথ মণ্ডল বলা হয়। ১১টি বালখিল্য সুক্ত এই মণ্ডলের অন্তর্গত।
ঋক সংহিতার সূক্তগুলি দেবস্তুতি মূলক হলেও বেশকিছু সূক্ত ধর্মনিরপেক্ষ, দার্শনিক ভাবধারায় পুষ্ট। ধর্মনিরপেক্ষ সূক্তের মধ্যে সংবাদসূক্ত, নারাশংসী এবং দানস্তুতিও অন্তর্ভূক্ত।
বালখিল্য সুক্ত
ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের ১১টি অতিরিক্ত খিল সূক্ত বালখিল্য ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট বলে ওই ১১টি অতিরিক্ত সূক্তকে বালখিল্য সূক্ত বলা হয়।
সংবাদ সূক্ত
দেবতার স্তুতিমূলক নয় এমন কুড়িটি সূক্ত ঋক সংহিতায় পাওয়া যায়। পারস্পারিক কথোপকথন আকারে রচিত এই সূক্ত সমূহকে সংবাদসুক্ত নামে অভিহিত করা হয়।
অগস্ত-লোপামুদ্রা সংবাদ(১/১৭৯), যম-যমী সংবাদ(১০/১০), অগ্নি-দেবতা সংবাদ (১০/৫১), ইন্দ্র-বৃষাকপি সংবাদ(১০/৮৬), পুরূরবা-ঊর্বশী সংবাদ(১০/৯৫), সরমা- পণি সংবাদ(১০/১০৮) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দার্শনিক সূক্ত
যে সমস্ত সূক্তে দার্শনিক ভাবধারায় পুষ্ট ঋষি-কবিদের মনন ও উন্নত চিন্তার বিচিত্র প্রকাশরূপে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে উন্নততর চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে, সেই সমস্ত সূক্তকে দার্শনিক সূক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়।
ইন্দ্রসূক্ত(২/১২), পুরুষসুক্ত(১০/৯০), হিরণ্যগর্ভসূক্ত১০/১২১), দেবীসূক্ত(১০/১২৫), রাত্রিসূক্ত(১০/১২৭), নাসদীয়সূক্ত(১০/১২৯), অঘমর্ষণসূক্ত(১০/১৯০)।
ধর্মনিরপেক্ষ সুক্ত
ঋগ্বেদ প্রধানতঃ ধর্মমূলক হলেও কিছু সূক্ত আছে যার সঙ্গে ধর্মের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই, সেগুলিকে ধর্মনিরপেক্ষ সূক্ত বলে। যথা :- ভেকসূক্ত (৭/১০৩), অক্ষসূক্ত (১০/৩৪), বিবাহসূক্ত (১০/৮৫)।
সমবেদ সংহিতা
তৃতীয় ঋত্বিকের কাজ ছিল গেয় সন্ত্রসমূহে সুর সংযোগ করে দেবতার প্রীতির উদ্দেশ্যে স্তবগান বা স্তুতিগীতি পরিবেশন করা। ইনিই উদ্দ্গাতা। উদ্গাতার গেয় মন্ত্রসমূহের সংগ্রহই সামসংহিতা বা ঔদ্গাত্রবেদ। চতুর্থ ঋত্বিকের কাজ ছিল পূর্বোক্ত ঋত্বিয়ের অনুষ্ঠিত ক্রিয়াকলাপের প্রতি সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা এবং তাঁদের কাজে কোনও ভ্রম বা প্রমাদ ঘটলে তা শুধরে দেওয়া। একই বেদ হোতা, অধ্বর্ষ এবং উদ্দ্গাতার করণীয় কর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিভক্ত হয়েছিল বলে বেদ ত্রয়ী নামে বিখ্যাত। মনে রাখতে হবে ত্রয়ী তিনটি পৃথক্ বেদ নয়, একই বেদের তিনটি অংশ মাত্র। মন্ত্রাত্মক বেদের সংহিতা হ’ল বেদের অনকাণ্ড। এই জ্ঞানকাণ্ড সাধারণভাবে পদ্যে বিধৃত, রুচিৎ গদ্যের নিদর্শন মেলে।
সামবেদের শাখা
সাম বেদের তিনটি শাখা – (১) রাণায়ণীয় (১৮১০টি সাম), (২) কৌথুমী এবং (৩) জৈমিনীয়।
সামবেদের বিভাগ
সামবেদ সংহিতা আর্চিক’ ও ‘গান’ – এই দুইভাগে বিভক্ত। আর্চিক দুইভাগে বিভক্ত – পূর্বার্চিক ও উত্তরার্চিক এবং গানগ্রন্থ চারভাগে বিভক্ত – গ্রামগেয়, অরণ্যগেয়, উহ ও উহ্য।
সামবেদ দুই ভাগে বিভক্ত – আর্চিক ও গান।
আর্চিক
ঋক ও গানের সংগ্রহকে বলা হয় আর্চিক।
দশতি
আর্চিকের প্রতিটি প্রপাঠকে দশটি করে সূক্তের সংকলন থাকে, একে দশতি বলে।
দশতির বিভাগ
দশতি তিনভাগে বিভক্ত – ছন্দঃ , আরণ্যক ও উত্তরা।
সামগান
পাদবদ্ধ ঋকমন্ত্রের সুরসহ আবৃত্তিশৈলী হল সামগান।
গ্রামগ্রন্থ
গ্রামগেয় (১৭ প্রপাঠক), অরণ্যগেয় (৬ প্রপাঠক), উহ (২৩ প্রপাঠক) ও উহ্য (৬ প্রপাঠক)।
সামগানের বিভাগ
সামগানগুলি পাঁচ ভাগে বিভক্ত -হিস্কার,প্রস্তাব, উদগীথ, প্রতিহার ও নিধান।
সামবেদের সপ্তস্বর
ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ।
সামবিকার
৬টি : বিকার, বিশ্লেষণ, বিকর্ষণ, অভ্যাস, বিরাম, স্তোভ।
যজুর্বেদ সংহিতা
ঋক ও সাম ব্যতীত অবশিষ্ট মন্ত্রই যজুঃ মন্ত্র। ইহা দুইভাগে বিভক্ত – কৃষ্ণ যজুর্বেদ (তৈত্তিরীয় সংহিতা) এবং শুক্ল যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী সংহিতা)।
যে ঋত্বিক মন্ত্রোচ্চারণ করে নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে হবি: আহুতি দিতেন, তিনি ছিলেন অধ্বর্যু” নামে পরিচিত। অধ্বর্পূর পঠনীয় মন্ত্রসমূহের সংগ্রহের নামই যজুর্বেদ সংহিতা বা আধ্বর্যর বেদ।
যজুর্বেদের বিভাগ
কৃষ্ণ যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা (৭টি কাণ্ড, ৪৪টি প্রপাঠক, ৬৪৪টি অনুবাক, ২১৮৪টি মন্ত্র) এবং শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী সংহিতা (৪০টি অধ্যায়, ৩০৩টি অনুবাক, ১৯১৫ কন্ডিকা)।
কৃষ্ণযজুর্বেদের শাখা
চারটি শাখা – (১) কাঠক, (২) কপিষ্ঠল, (৩) মৈত্রায়ণী, (৪) তৈত্তিরীয়।
শুক্ল যজুর্বেদের শাখা
দুটি শাখা – (১) কাণ্ব ও (২) মাধ্যন্দিন।
অথর্ববেদ সংহিতা
শুভজনক অথর্বন ও অশুভজনক আঙ্গিরস উভয় বিদ্যাই যে বেদে আছে তাকে বলা হয় অথর্বাঙ্গিরসবেদ বা অথর্ববেদ।
কিন্তু বেদ তো চারটি। লোকে চার বেদের কথাই জানে এবং বলে। ‘চার’ বলতে চারটি মন্ত্র-সংহিতাকেই বুঝতে হবে। চতুর্থ মন্ত্রসংহিতাটি অথর্ববেদসংহিতা। এটি পূর্বোক্ত ত্রয়ী ভিন্ন। জৈমিনি বা অপর কোনও মীমাংসক বা অন্য আর কেউ অথর্ববেদের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষণ করেন নি।
অথর্ববেদের শাখা
দুটি শাখা – (১) শৌনকীয় [২০টি কান্ড, ৩৮টি প্রপাঠক, ৯০টি অনুবাক, ৭৩১টি সূক্ত, ৬০০০টি মন্ত্র] এবং (২) পৈপ্পলাদ।
অথর্ববেদের নামান্তর :-
ভৃগ্বাঙ্গিরস (ভৃগু ঋষিগণ অগ্নিদেবতার উপাসক) এবং ব্রহ্মবেদ (ব্রহ্মা নামক পুরোহিতের মন্ত্র)।