মহাভারতের কাহিনী ও উপাখ্যান নিম্নে বর্ণিত হল । মহাভারতের বিভিন্ন গল্প তথা কাহিনী গুলি উপাখ্যান নামে বর্ণিত ।
Table of Contents
মহাভারতের কাহিনী ও উপাখ্যান
কুরু পান্ডবদের পারিবারিক বিবাহ ও পরিণামে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মহাভারতের মূল বিষয়বস্তু হলেও এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য কাহিনী ও উপাখ্যান ।
মহাভারতের মূলত তিন শ্রেনীর কাহিনী ও উপাখ্যান দেখা যায়-
- ১) সৌত উপাখ্যান,
- ২) ব্রাহ্মণ্য উপাখ্যান
- ৩) যতি,ভিক্ষু বা শ্রমণগনের উপখ্যান।
ক) সৌত উপাখ্যানঃ-
কুরু পাণ্ডবের বংশপরিচয়, বিরোধ, যুদ্ধ, পান্ডবদের জয় এবং অন্যান্য রাজবংশের, রাজগণের, বীরদের কাহিনীকেই সৌত উপাখ্যান বলা হয়। প্রাচীনকালে সূত জাতির বৃত্তি ছিল বিভিন্ন রাজবংশের বংশপঞ্জি ও বীরত্বকাহিনী রক্ষা করা। সে কারণেই এই সকল কাহিনীকে সৌত কাহিনী বলে। বংশপঞ্জীমূলক শ্লোকগুলোকে অনুবংশ শ্লোক এবং কোন রাজবংশ বা কোনো বিশেষ রাজা বীরের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী গুলিকে বীর্যগাথা বলা হয়।
শকুন্তলা উপাখ্যান
কুরু পান্ডবের কাহিনী ছাড়া দুষ্যন্ত- শকুন্তলার উপাখ্যান এই শ্রেনীর একটি কাহিনী। দুষ্যন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরতের নামানুসারেই এই দেশের নাম ভারতবর্ষ এবং আলোচ্য মহাকাব্যটির নাম মহাভারত হয়েছে। মহারাজ যমতির সঙ্গে দৈত্য গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর এবং দৈত্যরাজকন্যা শর্মিষ্ঠার বিবাহ, শর্মিষ্ঠাকর্তৃক দেবযানীর অবমাননা, শুক্রাচার্যের অভিশাপে যমতির জরাগ্রস্ততা এবং পুত্র যৌবনের বিনিময়ে যযাতির যৌবন প্রাপ্তি কাহিনী নিয়ে বিরচিত যযাতির উপাখ্যানটিও এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
দময়ন্তীর উপাখ্যান
এই শ্রেনীর অপর একটি সুবিখ্যাত ও অতি সুন্দর কাহিনী হল নল -দময়ন্তীর উপাখ্যান। এটা কাব্যসৌন্দর্যে অতুলনীয় এবং একটি অতিপ্রাচীন কাহিনী অবলম্বনে বিরচিত। দুর্ভাগ্যের তাড়ণায় মুহ্যবান রাজা যুধিষ্ঠিরকে শান্তনা দেবার উদ্দেশ্যে মহর্ষি বৃহদশ্চ এই কাহিনীটি বর্ননা করেন।
বিদুলার উপাখ্যান
এই শ্রেনীর অপর একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী হল বীরজননী বিদুলার উপাখ্যান।কাপুরুষতা পরিত্যাগ করে যুদ্ধে শত্রুর সম্মুখীন হওয়ার জন্য পুত্র সঞ্জয়কে জননী কিরুপে উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাই এই উপাখ্যানের বিষয়বস্তু এবং এই কাহিনীর মাধ্যমে উপদেশ দিয়ে পান্ডব জননী কুন্তি শ্রীকৃষ্ণকে পান্ডবদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন।
এই সকল কাহিনীগুলি আয়তনে যেমন বিশাল, তেমনি প্রাণবন্ত ও স্বয়ং সম্পূর্ণ বলে এরা প্রত্যেকেই এক একটি স্বতন্ত্র মহাকাব্যের মর্যাদা পেতে পারে।
খ) ব্রাহ্মণ্য উপাখ্যানঃ-
সর্পনিধনের উদ্দেশ্যে অভিচার প্রক্রিয়া, সর্পোপাখ্যান, গরুড়ের কাহিনী প্রভৃতি যে সকল উপাখ্যানের মাধ্যমে ব্রাহ্মণরা নিজেদের গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন ব্রাহ্মণদের দ্বারা বিরচিত সেই সকল উপাখ্যানকে বলা হয় ব্রাহ্মণ্য উপাখ্যান।
মনু- মৎস্য কাহিনীর মতো উপাখ্যান গুলি এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। অতি প্রাচীন মৃত্যু দেবতার কাহিনীটি দেখা যায় ব্রহ্মার শ্রেষ্ঠত্ব কিন্তু পরবর্তী কাহিনীগুলোর কোনোটিতে দেখি বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্ব আবার কোনোটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিবের শ্রেষ্ঠত্ব। সাবিত্রী সত্যবানের কাহিনীতে হ্বিনতারনিৎস সাহেব এই শ্রেণীর অন্তর্গত বলে মনে করেছেন। এর মাধ্যমে ধর্ম ও নীতির মহৎ আদর্শ প্রচারিত হয়েছে। আবার ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যানের মতো শ্লীল তার্বিত কাহিনীও এই শ্রেণীর অন্তর্গত। অগস্ত্যকর্তৃক সমুদ্রশোষণের কাহিনী উদ্দালক-আরুনির উপাখ্যান এবং নচিকেতার উপাখ্যানও ব্রাহ্মণ কাহিনীর অন্তর্গত। মহাভারতে শান্তিপর্বে ও অনুশাসন পর্বে এই শ্রেণীর বহু উপাখ্যান দেখা যায়।
গ) যতিধর্মীয় উপাখ্যানঃ-
মহাভারতের যে সকল উপাখ্যানের মাধ্যমে জীবে দয়া, অহিংসা, কর্তব্যনিষ্ঠা, বৈরাগ্য প্রভৃতি ধর্ম, নীতি ও দর্শনমূলক উপদেশ পরিবেশ করা হয়েছে সেগুলিকে হ্বিনতারনিৎস সাহেব যতিধর্মীয় উপাখ্যান নাম দিয়েছেন।
অনেকে এগুলিকে ইতিহাস সংবাদ বলেন। সর্বজনগ্রাহ্য বহুনীতি উপদেশমূলক কাহিনী এই অংশে সন্নিবেশিত আছে বলে এই অংশগুলিকে সাধারণভাবে নীতি খন্ড বা উপদেশখন্ড বলা চলে। এই অংশের মধ্যে উপনিষদে উল্লেখিত জনক বা যাজ্ঞবল্ক্যের কাহিনী প্রভৃতি অনেক প্রাচীন গল্পের সমাবেশ দেখা যায়।
সমুদ্র ও নদীর কথোপকথনের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে,বৃহৎ শক্তির সম্মুখে নতিস্বীকার এর দ্বারা বিপদ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যায়। জীবহিতে আত্মদানের মহান উপদেশ বিধৃত আছে শিবিরাজের উপাখ্যান। ব্যাধ ও কপোতের কাহিনীতে প্রচার করা হয়েছে যে, শত্রুর প্রতিও প্রেম ও মৈত্রী প্রদর্শন করা উচিত। নীতি, ধর্ম ও মোক্ষ বিষয়ক নানা কাহিনীও এই অংশে আছে।
শান্তিপর্বে রাজনীতিবিষয়ক অনেক আলোচনা দেখা যায়। চিরকালের কাহিনী, গৌতম, ব্যাধ, সর্প, মৃত্যু ও কালের কাহিনীও সুনিপুণভাবে অঙ্কিত। ধর্মব্যাধ -এর কাহিনীতে দেখানো হয়েছে যে বর্ণ অপেক্ষা জ্ঞানের গৌরব অনেক বেশি। এই সকল কাহিনীর অধিকাংশই গাধা রূপে প্রচলিত ছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যেও এইরূপ কাহিনী দেখা যায়। কতকগুলি আবার একটু পরিবর্তিত আকারে চীন,জাপান, তিব্বত প্রভৃতি দেশের কাহিনীতে পাওয়া যায়।
- এছাড়া আরো অনেক মহাভারতের কাহিনী ও উপাখ্যান দেখা যায় – যেমন –
আর্য উপাখ্যান :
মহাভারত, পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, আর্য নারীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত মন্দ চরিত্রের অন্ধ ঋষি গঙ্গার জলে ভেসে আসার সময় নিঃসন্তান অনার্য বলিরাজ তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং নিজের স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে সন্তান জন্ম দেয়ার কাজে নিযুক্ত করে। সুদেষ্ণার সঙ্গে ঋষির মিলনে ৫টি পুত্রসন্তান জন্ম লাভ করে। এ ক্ষেত্রজ পুত্রদের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুম্ম। বলিরাজ তাদের এ ক্ষেত্রজ পুত্রদেরকে ৫টি রাজ্য দান করেন। পুত্রদের নামানুসারে রাজ্যগুলোর নামকরণ করা হয়।