সংস্কৃত গীতিকাব্যের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দাও।
Table of Contents
সংস্কৃত গীতিকাব্যের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ
উ:- গীতি কবিতাকে আধুনিক কবি মানসের গভীর গোপন অন্তরলোকের কাব্যিক আত্মপ্রকাশ বলে মনে করা যায়। কবির ব্যাক্তিগত আবেগানুভূতি কিংবা হৃদয়ের কোন নিভৃত বাসনা যখন গীতিছন্দে মুক্তিলাভ করে তখনি তা গীতি কবিতা রূপে অভিহিত হয়। কবি আপন অন্তরের গভীরে সন্ধিৎসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বীয় অভিজ্ঞতা, চিন্তা ও অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন-
“The poet goes into himself and finals his inspiration and his subjects in his own experience, thoughts, and feelings.”
গীতিকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সঙ্গীত ধর্মিতা। আধুনিক আলংকারিকেরা এই শ্রেণীর কাব্যকে গীতিকাব্য নামে অভিহিত করেন। ইংরেজিতে এর নাম ‘Lyric poetry ‘. ইংরেজী Lyre শব্দটি থেকে Lyric এসেছে। Lyre শব্দের অর্থ বীনা বা তজ্জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। সংস্কৃত খাঁটি গীতিকাব্য বিরল হলেও কিছু কাব্যে কবির প্রগাঢ় ভাবানুভূতি, নিসর্গ প্রীতি ও সুমধুর সঙ্গীতধর্মী ভাষা দেখা যায়। হৃদয়াভাবে ঐকান্তিকতায়, কল্পনার কামনীয়তায়, ছন্দের দোলায় অগেয় গান ও গীতিময় হয়ে পড়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
” যে গান কানে যায় না শোনা, যে গান যেথায় নিত্য বাজে।”
গীতিকাব্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে আচার্য বরদাচারী বলেছেন-
“A lyric can therefore be an expression of a feeling, thought or sentiment whether it be of love, grief or devotion.”
সংস্কৃত গীতিকাব্য
সংস্কৃত গীতিকাব্যকে মোটামুটিভাবে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে- প্রেমমূলক, নীতিমূলক ও ধর্মমূলক। গীতিকবিতার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় বেদের ঊষা সূক্তে। পরবর্তীকালে রামায়ণে ক্রৌঞ্চের মৃত্যুতে ক্রৌঞ্চ বধূর ক্রন্দনে ঋষি বাল্মীকির হৃদয়েও যে শোকের অনুভূতি ঘটেছিল তাতে গীতিময়তার আবেগ লক্ষ্য করা যায়, তাছাড়া রাম সীতার বেদনার আবেগও গীতিকাব্য গুণান্বিত। আরও পরবর্তীকালে অশ্বঘোষের সৌন্দরানন্দ, কালিদাসের ঋতুসংহার ও মেঘদূত, অমরুর শতককাব্য, জয়দেবের গীতগোবিন্দ প্রভৃতি গীতি কাব্যের নিদর্শন।
ঋতুসংহার:-
প্রকৃতির বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত অন্যতম প্রেমমূলক গীতিকাব্য হল ঋতুসংহার। বিশ্ববরেণ্য মহাকবি কালিদাস ছয়টি সর্গে ছয়টি ঋতুর মনোজ্ঞ বর্ণনা এখানে উপস্থাপিত করেছেন। প্রকৃতিতে পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব চিত্তে কি কি পরিবর্তন আসে তার বর্ণনায় কালিদাস নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও বর্ষার বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি বলেছেন- ” বর্ষায় নব মেঘের গর্জনে ময়ূর আনন্দে তার পদ্মপত্রের ন্যায় চক্রাকার নীল বর্ণের পেখম বিস্তার করে। এই সময় পদ্ম মধুর আশায় পদ্মপত্রে ভ্রমে ভ্রমর ময়ূরের পেখমেই গিয়ে বসে পড়ে-
” বিপত্রপুষ্পাং নলিনীং সমুৎসুকা,
বিহারভৃঙ্গাঃ শ্রুতিহারিনী স্বপ্নাঃ।
পতন্তি মূঢ়াঃ শিখিনাং প্রনৃত্যতাং,
কলাপচক্রেষু নবোৎপলাশয়া।।”
মেঘদূত:-
শুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করে রচিত কালিদাসের প্রেমমূলক গীতিকাব্য মেঘদূত বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী, মন্দাক্রান্তার মেঘমন্ত্র শ্লোকে এক বিরহি যক্ষের কামনার আর্তি এখানে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা বাণীটি হল-
” কবিবর কবে কোন বিস্মৃত বরষে কোন পূণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে লিখেছেন মেঘদূত।।”
প্রভু কুবেরের অভিশাপে রামগিরি পর্বতে যক্ষ এক বছরের জন্য নির্বাসিত হন। প্রিয়া বিরহের গুরুভাব বর্ণনায় পূর্বমেঘ কাব্যের আরম্ভ-
“কশ্চিৎ কান্তা বিরহ গুরুণা স্বাধিকার প্রমত্ত।”
সময়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে বর্ষার এক খন্ড মেঘকে গিরি মল্লিকা ফুলের অর্ঘ্য সাজিয়ে তাকে বরণ করে দূত হিসাবে কামার্ত্য যক্ষ নিজ পত্নীর কাছে যেতে অনুরোধ করেছেন। পূর্বমেঘ অংশে মেঘের যাত্রাপথ অতি মনোহর-
“বক্রঃ পন্থা যদ্যপি ভবতঃ।”
শ্লোকটিতে মেঘকে উদ্দেশ্য করে যক্ষ বলেছেন উজ্জয়িনীর পথটা বাঁকা হলেও তুমি না দেখে যেও না। এ থেকে কবির ভৌগোলিক জ্ঞানের যথার্থ পরিচয় পায়।
আবার যক্ষ মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- সে যেন শান্ত ও স্থির বাক্যে তার সন্দেশ তার স্ত্রীকে জানায়। কারণ সুখ দুঃখ কালের গতিতে আবর্তমান-
” কস্যৈকান্তং সুখমুপনতং দুঃখমেকান্ততো বা
নীচৈগর্চ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রনেমিক্রমেন।।”
এই প্রসঙ্গে পথ নির্দেশ রুপে রামগিরি থেকে অলকাপুরী পর্যন্ত পথের বিভিন্ন নদ-নদী, নগরের অলকাপুরী যক্ষ গৃহের ও যক্ষ পত্নীর অপূর্ব চিত্রধর্মী হৃদয়মোহিনী বর্ণনার সাথে বিরহ বধূর হৃদয়ের নানার চিত্র এই কাব্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু কালিদাসের অমর লেখনীতে বিশ্ববন্দিত কাব্যরূপ লাভ করেছে।
অমরুশতক:-
অবিমিশ্র প্রেমকে বিষয়ীভূত করে কবি অমরু তার শতককাব্য রচনা করেছেন। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্লোকে কাম বা প্রেমের বিভিন্ন অবস্থা চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কবির মতে, প্রেম তারুণ্যের একটি ফসল- জীবনের সুখ, সম্ভোগ, আনন্দ, বেদনায় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই কাব্যের জনৈকা তরুনীর ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে বঞ্চিত প্রেমের হতাশা। সমগ্র কাব্যে শৃঙ্গারের নানার অবস্থা বর্ণনায় কবি অমরুর বৈদগ্ধ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্জুন বর্মদেবের অমরু প্রসস্তি উল্লেখযোগ্য-
” অমরুককবিত্বভমরুকনাদেন বিনিহ্নতান ণ সঞ্চরতি।
শৃঙ্গারভনিতিরন্যা ধন্যানং শ্রবনবিবরেষু।।”
অমরুশতক কাব্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
গীতগোবিন্দ:-
ভগবৎ ভক্তিমূলক গীতিকাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ মধুর কমলাকান্ত পদাবলী, গীতগোবিন্দ ভক্তি রসের প্লাবনে আপামর ভারতবাসীকে আপ্লুত করেছে। ছন্দ সম্রাট সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার বন্দনায় লিখেছেন –
বাংলার রবি জয়দেব কবি
কান্ত কোমলপদে।
করেছে সুরভি সংস্কৃতের
কাঞ্চন কোকনদে।।”
কবির বারোটি সর্গে রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনা করেছেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেম সাধারণ প্রেম নয় , এ প্রেম অপার্থিব, এ প্রেম অলৌকিক, এ প্রেমের মধ্যে কামনার লেশ নেই। এ প্রেম নির্মল, সুন্দর, সূচী। চৈতন্য চরিতামৃতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
” আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেমনাম।।”
বাস্তবিকভাবে কাব্যটি নায়ক – নায়িকার উক্তি প্রত্যক্তির ছলে রচিত। মূল কাব্যের আরম্ভ বসন্তকালের বর্ণনা দিয়ে। যমুনা তীরে বৃন্দাবনে বসন্ত সমাগত, কোকিলের কূজনে কুঞ্জ কুটির পরিপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে কৃষ্ণ যেন স্বয়ং মূর্তিমান শৃঙ্গার। অপরদিকে রাধার প্রতীক্ষায় কৃষ্ণ অধীর। পত্র পতনের শব্দেও রাধার চমকিত-
” পততি পতত্রে বিচলিত পত্রে শঙ্কিত ভবদুপয়াণম্।
রচয়তি শয়নং সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।।”
হরি বিরহে রাধার উক্তিটি সত্যই স্মরণীয় -‘মম মরণেব বরণ’। মূর্খ মাধব কর্তৃক রাধার মানভঞ্জনের প্রয়াসের ভাষাও সুমধুর –
“ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনম্।
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।।”
এইভাবে জয়দেবের কোমলকান্ত পদাবলীর পদলালিত্য ও লোলিতমাধুরী সত্যই হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।।
উপরিক্ত গীতিকাব্যগুলি ছাড়া ধোয়ীর পবনদূত, দামোদর গুপ্তের কুট্টিনীমত, ময়ূর কবির ময়ূরাষ্টক্ ও সূর্যশতক, বাণের চন্ডীশতক প্রভৃতি গীতিকাব্যগুলি সংস্কৃত গীতিকাব্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
মধুর কোমলাকান্ত পদাবলির নিদর্শন গীতগোবিন্দ ভক্তিরসের প্লাবনে আপামোর ভারতবর্ষকে আপ্লুত করেছে । কবি জয়দেব নিজেই বলেছেন-
” যদি হরিস্মরণে সরসং মনো
যদি বিলাসকলাসু কুতূহলম্
মধুরকোমলাকান্ত পদাবলীং
শৃনু তদা জয়দেব সরস্বতীম্”।।
অর্থাৎ যদি হরিকে স্মরণ করতে মন ব্যাকুল হয়। যদি তার বিলাসকলাতে কৌতূহল থাকে, তাহলে জয়দেবের মধুর কোমলকান্ত পদাবলীর শ্রবণ করুন। এইভাবে জয়দেবের কোমলকান্ত পদাবলীর পদলালিত্য ও লোলিতমাধুরী সত্যই হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।
শতকত্রয়:-
কবি ভর্তৃহরি বিরচিত শৃঙ্গার শতক, নীতি শতক ও বৈরাগ্য শতক সংস্কৃত সাহিত্যে শতকত্রয় নামে পরিচিত। শৃঙ্গারশতকে রমনীর শারীরিক সৌন্দর্যের আকর্ষণের বর্ণনার মাধ্যমে নারীকে নরকের দ্বার এবং যৌবনকে বৃথা প্রলোভন রূপে অভিব্যাঞ্জিত করা হয়েছে। নীতিশতকে জীবনের আদর্শ ও নৈতিক আচরণ সম্পর্কে নানা উপদেশ আছে। বৈরাগ্য শতকে জীবনকে মায়া রূপে চিত্রিত করে সন্ন্যাস গ্রহণের উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
চৌরপঞ্চাশিকা:
কাশ্মীরি কবির বিলহন কর্তৃক রচিত চৌরপঞ্চাশিকা পঞ্চাশটি সুন্দর ও তীব্র আবেগময় শ্লোকে বিরোচিত একখানি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি গীতিধর্মী কাব্য। বধ্যভূমিতে উপনীত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিরহ বধূর প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকার বিভিন্নভাবে স্মৃতির রোমান্থানের কাব্যময় প্রকাশ এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। নায়ক এখানে প্রেমের জন্য মৃত্যুকে বরন করতেও কুণ্ঠিত নয়-
” অদ্যাপিতৎ কমলরেনুসুগ্ধগন্ধি তৎ প্রেমবারি মবারধ্বজপাতকারি।।”