সামবেদ সংহিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল। সামবেদ সংহিতার বিভাগ ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
সামবেদ সংহিতা
ঋকবেদ ও অথর্ববেদ সংহিতা দুটি সর্বসাধারণের কোন বিশেষ ধর্মীয় প্রয়োজনে রচিত হয়নি। সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্যে এদের আবির্ভাব একথা বলা হলেও যজুর্বেদ ও সামবেদ সংহিতা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুটি সংহিতার যেসব মন্ত্র দেখতে পায় তা যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রম অনুসারে সাজানো। আসলে এই দুটি সংহিতা বিশেষ বিশেষ যজ্ঞে পুরোহিতদের ব্যবহারের জন্য প্রার্থনা বা সংগীত মন্ত্রের সংকলন ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রাচীন ভারতের যাগযজ্ঞ বিষয়ে একটি বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া বৈদিক সাহিত্য ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় না। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের আমরা যেটুকু পরিচয় পায় তাতে দেখা যায় যে, দুপ্রকারের ধর্মকর্ম প্রচলিত ছিল।
শ্রৌতকর্মে চারজন প্রধান পুরোহিত নিযুক্ত হতেন তারা হলেন- হোতা, উদগাতা, অর্ধ্বযু এবং ব্রহ্মা। ব্রহ্মা সকল বেদে অভিজ্ঞ হতেন। অবশিষ্টেরা যথাক্রমে ঋক, সাম ও যজুর্বেদে অভিজ্ঞ। সামবেদ সংহিতা উদগাতার ব্যবহারের জন্য মন্ত্রের সংকলন সামবেদের অধিকাংশ মন্ত্রই ঋকবেদ থেকে নেওয়া।
সামবেদে ১৬০৯ টি মন্ত্রের মধ্যে মাত্র ৭৫ টি নিজস্ব। বাকি গুলি সব ঋকবেদ থেকে নেওয়া। ঋকবেদের যে মন্ত্র গুলি সামবেদে আছে তার অধিকাংশ ঋকসংহিতায় অষ্টম ও নবম মন্ডলে দেখা যায়। ঋকমন্ত্রগুলি সামবেদে পুনরাবৃত্ত হলেও প্রধান পার্থক্য এই যে,ঋকবেদের মন্ত্রগুলি গানশূন্য। আর সামবেদের মন্ত্রগুলি গানপূর্ণ। মন্ত্রের পদগুলি উভয় সংহিতায় এক হলেও ঐ একই পদ ঋকবেদে গীতিশূন্য ও সামবেদে গীতযুক্ত করে ওদেরকে পরস্পর পৃথক করে দিয়েছে। ঋকবেদের পাদবদ্ধ মন্ত্র গুলিতে সুর সংযোগ করলেই তা সামে পরিণত হয়। গান হল সামসূক্তের প্রাণ। ঋকবেদের মন্ত্রের সাহায্যে দেবতাদের আহ্বান করা হয়।আর সামবেদের মন্ত্রের মাধ্যমে দেবতাদের স্তুতিগান করা হয়।
সামবেদে হাজারটি শাখা ছিল বলে একে সহস্রবর্ত্মা বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে তিনটি শাখা পাওয়া যায়।
যথা-
i) রানায়নীয়, ii) কৌথুমী, iii) জৈমিনীয়
এদের মধ্যে কৌথুমী বিশেষ প্রসিদ্ধ। রানায়নীয় ও কৌথুমী শাখার মধ্যে কোন মন্ত্র ভেদ নেই। শুধু গণনার পদ্ধতিতে ভেদ রয়েছে। রানায়নীয় মন্ত্র গণনা করা হয় – প্রপাঠ, অর্ধপ্রপাঠ ও দশতি অনুসারে। আর কৌথুমীরা গণনা করেন অধ্যায় ও খন্ড অনুসারে। জৈমিনীয় সংহিতায় মন্ত্রের সংখ্যা কিছু কম, কিন্তু গানের সংখ্যা বেশি।
কৌথুমী শাখার মতে, সামবেদ সংহিতা দুভাগে বিভক্ত –
i) আর্চিক এবং ii) গান।
আর্চিকের প্রায় সকল মন্ত্রই শাকল শাখা থেকে নেওয়া।
আর্চিকের আবার দুটি ভাগ-i) পূর্বার্চিক ও ii) উত্তরার্চিক।
পূর্বার্চিকের মন্ত্রগুলি যজ্ঞের সময় বিবিধ রাগ অনুসারে গান করা হত। এখানে ৫৮৫ টি ঋক আছে। উত্তরার্চিকের ৫০০ টি সাম আছে। প্রতিটি সামে তিনটি ঋক আছে। উত্তরার্চিকের মন্ত্রগুলি প্রধান প্রধান যজ্ঞে গান করা হত।
আর্চিক খন্ডের মন্ত্রগুলি কিছুটা ছন্দ অনুসারে এবং কিছুটা দেবতা অনুসারে সাজানো। কিন্তু উত্তরার্চিকের প্রধান প্রধান যাগে পারম্পর্য অনুসারে সাজানো। কণ্ঠ ও যন্ত্র উভয় প্রকার সঙ্গীতের মাধ্যমে সামগান করা হয়। প্রতিটি রাগে এক একটি বিশেষ বিশেষ নাম ছিল। সুতরাং সামবেদ সংহিতার ভারতীয় যজ্ঞ মন্ত্রে ও ইতিহাসের দিক দিয়ে অপ্রয়োজনীয় নয়। এতে যে গানের উপাদান সংযোজিত হয়েছিল তা নিশ্চিতই ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে প্রয়োজনীয়।
সামবেদের দুটি প্রধান রাগ হল- i) বৃহৎ ও ii) রথন্তর।
স্বরগুলির স্বরলিপি সংহিতার যে অংশে সংকলিত হয়েছে তাকে বলে গান।
এরূপ চারটি গান সংহিতায় আছে- i)গ্রামগেয়, ii) অরণ্যগেয়, iii) ঊহ এবং iv) উহ্য। গ্রামগেয় গানে পূর্বার্চিকে প্রথম তিনটির স্বরলিপি আছে। আর পূর্বার্চিকের অরণ্যকান্ড ও পরিশিষ্টে স্বরলিপি আছে অরণ্যগেয় গানে।
যে গান সকলের সামনে গাওয়া যায় তাকে বলে গ্রামগেয়। আর যে গান নির্জনে গাইতে হয় তার নাম অরণ্যগেয়। উত্তরার্চিকের স্বরলিপি ঊহ এবং উহ্য গানে। উহ্য গানের স্বরলিপি বিন্যাস ঊহগানের মতো যজ্ঞবিধি অনুসারে। কিন্তু এর ভিত্তি হল অরণ্যগেয় গানে। অর্থাৎ যজ্ঞে যেসব রহস্যগান গাইতে হয় সেগুলি এর মধ্যে পড়ে। ঊহ গ্রামগেয় গানের নির্দেশ আছে। আপস্তম্বের ধর্ম সংহিতার কুকুরের ডাক, গাধার স্বর ,বৃকের চিৎকার, শৃগালের চিৎকার, পেঁচার শব্দ, বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি এদের এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। এসকল ধ্বনি শোনা গেলে ঋক ও যজুর্বেদের পাঠ বন্ধ রাখার নিয়ম আছে। সামবেদ আর্থ সঙ্গীতের উৎসভূমি।
এই যুগের প্রথম পর্বে ভারতীয় সংগীতের ৭টি স্বরের তিনটি স্বর পাওয়া যায়। যথা- i) ষড়জ, ii) ঋষভ এবং iii) নিষাদ। শেষপর্বে ৭টি স্বরের উদ্ভব হয়েছিল।
ঋকবেদে তিনটি স্বর আছে- i)উদাত্ত, ii) অনুদাত্ত এবং iii) স্বরিত।
সামবেদ পাঠের সময় ৭ টি স্বর পাঠ করা হয়। যথা-i) , ii) প্রথম, iii) দ্বিতীয়, iv) তৃতীয়, v) চতুর্থ, vi) মন্ত্র এবং vii) অতিস্বার্য।
এই সাতটি স্বর লৌকিকে যথাক্রমে i)ষড়জ, ii) ঋষভ, iii) গান্ধার, iv)মধ্যম, v) পঞ্চম, vi) বৈবত ও vii) নিষাদ।
অতএব ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে সাম সংহিতার গান গুলির গুরুত্ব অপরিসীম, একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয়। যদিও সাহিত্যকৃতি হিসাবে আমাদের কাছে সামবেদের গুরুত্ব অতি অল্পই।